ইউএনএইচসিআর’সহ জাতিসংঘের দুুটি সংস্থার দেয়া তথ্য অনুসারে, দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় সমুদ্র পথে ১ লাখ ১৩ হাজার মানুষ পাচারের শিকার হয়েছে। যাদের মধ্যে সাগরেই মারা গেছে প্রায় এক হাজার।
এ সাগরে ভাসার বিবরণ এমনই হূদয় বিদারক যে লিখে তা বোঝানো কঠিন। গন্তব্যহীন যাত্রায় না খেয়ে অনেকে মারা যাচ্ছে। যেসব ছোট ছোট জাহাজে করে তাদের নেয়া হচ্ছে বিশাল সাগরে এগুলো দুলছে অনেকটা কাগজের নৌকার মতো। পানি-খাবারের অভাবে অসহায় মুখগুলো কারও সহায়তাই পাচ্ছে না।
জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক গণমাধ্যমগুলোতে তাদের নিয়ে প্রতিদিনই খবর প্রকাশ হচ্ছে। সমূদ্রে দুর্দশা কবলিত এসব মানুষের খবর প্রতিদিন উদ্বেগ উত্কণ্ঠা বাড়াচ্ছে। শেষ পর্যন্ত জাতিসংঘ এ অসহায় মানবতা দেখে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েছে। ভাসমান এ মানুষগুলোকে কূলে ভিড়তে দেয়ার জন্য মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। শেষ পর্যন্ত তাদের এলাকায় থাকা সাত হাজার সমুদ্রে ভাসা মানুষকে তারা আশ্রয় দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতদিন তারা তাদের ঢুকতে দেয়নি। এ সাত হাজারের বাইরে আরও অনেক মানুষ সমূদ্রে এখনও ভাসছে। তাদের ভাগ্যে কি আছে কেউ জানে না।
কেন এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তা কারও অজানা নয়। মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা জাতিগত বর্বরতার শিকার হয়ে অস্তিত্ব রক্ষায় মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে। আর এজন্য মাছ ধরার ট্রলার কিংবা নৌকায় করে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে মালয়েশিয়া যাবার চেষ্টা করছে তারা।
এসব রোহিঙ্গারা গত কয়েক বছর ধরে চট্রগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে এসে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশি কিছু দরিদ্র মানুষ।
দুই দেশের এই মানুষগুলো ভালো উপার্জনের প্রলোভনে মানব প্রাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে সর্বশান্ত হচ্ছে। এমনকি প্রাণ হারালেও অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ পথে বিদেশে যাবার প্রবণতা কমছে না। স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে, হঠাত্ করে কেন এই অবৈধ সমুদ্র যাত্রা শুরু হলো? জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনের হিসেবে, ২০১৫ সালে প্রথম তিন মাসেই ২৫ হাজার বাংলাদেশি অবৈধ ও বিপদজনক পথে সাগর পাড়ি দিয়ে মালয়েশিয়া যাবার উদ্দেশ্যে নৌকায় উঠেছিল। আর অবৈধ পথে মালয়েশিয়া যেতে আগ্রহী এই বাংলাদেশিরা পড়ে গেছে মানবপাচারের এক আন্তর্জাতিক চক্রের প্রভাবে। দালালরা ছড়িয়ে পড়েছে এমন সব অঞ্চলে যেখানকার মানুষের দেশ ছাড়ার প্রবণতা আগে ছিল না। দালালরা সর্ব খরচে ভালো উপার্জনের লোভ দেখিয়ে দরিদ্র বেকার যুবকদের পাচার করছে। বিদেশে যাত্রার নামে অপহরণের শিকার হচ্ছে তারা। কারণ এদের নৌকায় তুলে দিয়ে পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায় করা হচ্ছে। বিক্রি করে দেয়া হচ্ছে শ্রমদাস হিসেবে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের তথ্য অনুসারে, মালয়েশিয়া যাবার কথা বলে আসলে এদের থাইল্যান্ড পাচার করে দেয়া হচ্ছে। থাইল্যান্ডের চিংড়ি সি ফুড শিল্পেও কাজ করে প্রায় সাড়ে ৬ লাখ শ্রমিক। যাদের অর্ধেকই ত্রীতদাস। এদের মধ্যে একটি বড় অংশ বাংলাদেশি। থাইল্যান্ডে মালয়েশিয়ার অনেক অঞ্চলে মানবপাচারকারীরা গড়ে তুলেছে ভিনদেশি বন্দি শিবির। অভিবাসী শ্রমিকদের দাসের মতো খাটানোর চেষ্টা চলছে সেখানে। আর অবৈধ পথে শ্রমিক এলে তাদের জন্য সুবিধা হচ্ছে।
মানুষকে দাস হিসেবে পাচার করে দেয়ার চেষ্টা খুবই উদ্বেগজনক। গভীর সমুদ্রে ক্ষুধা-পিপাসায় কাতর হয়ে মানুষ ভাসছে। কেউ কেউ সেখানেই মারা যাচ্ছে, এটা ভাবাও কষ্টকর। বিদেশে যাত্রার নামে নেমে এসেছে চরম এক মানবিক বিপর্যয়। এ বিপদ রোধ করতে সরকারসহ সকলকে এখনই ব্যাপকভাবে কাজ শুরু করতে হবে। পাচারকারী রুট এবং দালালদের চিহ্নিত করে আইনের আশ্রয়ে আনতে হবে। একইসঙ্গে বৈধ পন্থায় জনশক্তি রফতানির উদ্যোগ বাড়াতে হবে। জনসংখ্যাকে বোঝা মনে না করে মূল্যবান মানবসম্পদ হিসেবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করতে হবে। না হলে সাগরে না খেয়ে মৃত্যু সংবাদ ও বেকার যুবকদের বিদেশে যাবার আকাঙ্ক্ষা দমানো যাবে না। সাগরে তো এখন শুধু মানুষ ভাসছে না। ভাসছে এখন মানবতাও।