বৃহস্পতিবার  ৩০শে মার্চ, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ  |  ১৬ই চৈত্র, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ  |  ৭ই রমজান, ১৪৪৪ হিজরি

বাংলা বাজার নিউজ এর পক্ষ থেকে শুভ নববর্ষ

আনিসুজ্জামান ১৪ এপ্রিল, ২০১৫ ইং

এক রাত্রির মধ্যেই কি পুরাতন বছরের জীর্ণতা ও ক্লান্তির অবসান ঘটে, কবি যেমন করে কল্পনা করেন। পঞ্জিকার পাতা খসে যায় ঠিকই, কিন্তু জীবনে কি নতুন পাতার সূচনা হয় তেমন করে? নববর্ষের দিনে সবকিছু কি নতুন হয়ে দেখা দেয়। এত গান, এত ফুল, এত আলো সবই নতুনকে অভ্যর্থনা করছে। কিন্তু আমি কি সত্যিই নতুন হয়ে উঠছি রাতারাতি? রাতারাতি যে জীবনের বড় রকমের পরিবর্তন হতে পারে না তা তো নয়। নবদম্পতির পক্ষে বিয়ের আগের রাত ও পরের রাতে অনেক পার্থক্য। বেকার যুবক কর্ম খুঁজে পেলে এক রাত্রির ব্যবধানে তার জীবনে অনেক পার্থক্য ঘটে যায়। ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর সকাল আর তার পরের দিন সকালের ব্যবধান যোজন যোজন দূরের। পিতা-মাতার, স্ত্রীর-স্বামীর, সন্তানের বিয়োগ এক রাতে কত কিছু বদলে দেয়। একটি রাত্রি অন্তত হয়ে উঠতে পারে নানা পরিপ্রেক্ষিতে। নববর্ষের দিনটিতে আসলে কি তেমন কিছু ঘটে। না এবং হ্যাঁ, অনেক দিন দিয়েই বছরের প্রথম দিনটি বিগত দিনের থেকে খুব যে আলাদা, তা নয়। কিন্তু মনরাজ্যে যে একটা বিশেষ অনুভূতি জাগে নববর্ষে তা দিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে, এদিনটি অন্য অনেক দিনের থেকে আলাদা। একে আলাদা করে দেখার এবং আলাদা করে পাওয়ার জন্য আমাদের মনে একটা প্রস্তুতি থাকে। তাই এর শোভাযাত্রা পৃথক, ব্যঞ্জনা ভিন্ন।

ছেলেবেলায় প্রায়ই নববর্ষের দিনটিকে ঘিরে আমরা অনেক প্রতিজ্ঞা করতাম। এ বছরে একেবারে গোড়া থেকে ঠিক মতো পড়াশোনা করব, ভালো হয়ে চলব। কেউ হয়তো যে লেখাটা ঘুরপাক খাচ্ছে মনের মধ্যে, সেটা এবারে লিখে ফেলতে সংকল্পবদ্ধ হতেন। কেউ অন্য কিছু অর্জনের কথা ভাবতেন। প্রকৃত প্রস্তাবে হয়তো সে সংকলনটা রক্ষা করা সম্ভবপর হতো না, সে আশা পূর্ণ হতো না। কিন্তু ওই যে নতুন করে শুরুর ভাবনা সেটা কিন্তু মিথ্যে ছিল না।

বছরের প্রথম দিনটি আবির্ভাব সম্পর্কে যে সচেতন, তার কাছে সেদিন সকলই শোভন, সকলই নবীন, সকলই বিমল, আকাশ সুনীল, কানন শ্যামল, জোসনা বিশদ, কুসুম কোমল যদি না অন্য কোনো শোকসন্তাপ তা অধিকার করে। কিন্তু তারপরও কিছু আছে।

নববর্ষ আমাদের জাতীয় সত্তার স্মারক, আমরা যে আর কেউ নই, আমরাই নববর্ষ তা স্মরণ করিয়ে দেয় যেমন আমাদেরকে তেমন অন্যদেরকে।

আমরা খ্রিস্টীয় নিউ ইয়ারস্ ডে-তে প্রাণভরে আনন্দ করতে পারি, ইরানীদের নবরোজে মেতে উঠতে পারি, কিন্তু অন্তরের অন্তঃস্থলে জানি, সেটা আমার নয়, অন্যের। আমি তার কাছে অভ্যাগত, আগুন্তুক। তাকে আমি বরণ করতে পারি, কিন্তু তাও বাইরের মানুষ হিসেবেই। অন্যপক্ষে, আমার নববর্ষটি একান্তই নিজের, আমার সত্তার সাথে তা জড়িয়ে আছে। বাংলা নববর্ষ পালন নিয়ে যে আমাদের একদা শাসকশ্রেণির সঙ্গে আমরা এত অতর্কবিতর্ক, বাদ প্রতিবাদ করেছি, তার মূলে এই ভাবনাটাই কাজ করেছিল। নববর্ষ তো এককালে মূলত হালখাতায়, বড়জোর মেলার উত্সব ছিল। সেটা পূর্ব বাংলায় যে হয়ে উঠেছিল প্রধানত সাংস্কৃতিক উত্সব তার মূলে ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রেরণা। শাসকরা দিনটি পালনে যত বাধা দিয়েছে, যত নিরাপত্তা প্রকাশ করেছে, আমরা ততই বলে উঠেছি, বাধা ছিল বাঁধবে লড়াই। তাই নববর্ষ দিবসটি হয়ে উঠেছে আমাদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব রক্ষার প্রতীক, সংগ্রামের বিষয়।

সংগ্রাম যখন শেষ হয়েছে, তারপরও নববর্ষ পালনে উদ্দামতা দেখা দিয়েছে—সেও আত্মপরিচয়ের নিরিখেই। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নিত্যবিকাশমান সৃজনশীলতা। চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে রংবেরঙের মুখোশ নিয়ে যে মিছিল হয় তাতে এই সৃজনশীলতারই একটা প্রকাশ আমরা দেখি। এর মধ্যে রং আছে, আনন্দ আছে, স্ফূর্তি আছে—অন্য কিছু নেই। দেবদেবী নেই, জীবপূজা নেই। সেই আনন্দের প্রকাশ ঘটে নিত্যদিন যা খাই না তা খেয়ে, পারলে নতুন কাপড় পরে, কিন্তু অবশ্যই গান গেয়ে, সাজসজ্জা করে। এবারে কাগজেও বেশ লেখালেখি হচ্ছে—নববর্ষ পালন উপলক্ষে জামাকাপড়ের দাম বেড়ে যাচ্ছে। জাটকা ধরে ইলিশের বংশো ধ্বংস হচ্ছে, সেসবেরও উচ্চমূল্য। কিন্তু কাপড়-চোপড় কেনা তো অন্য উত্সবেও হয়, জাটকা ধরা অন্য মৌসুমেও হয়। বিত্তের বিজ্ঞাপন সবসময়ই অরুচিকর। কিন্তু তা যে নববর্ষ উপলক্ষেই প্রকাশ পায় তা কিন্তু নয়।

নববর্ষের নতুন প্রভাব যে আলোকে উদ্ভাসিত করে, তা যেন আমাদের মনের এবং বাইরের সকল অস্বীকার দূর করে দেয়। তাই প্রকৃতির মতো আমরা উদার হতে পারি। আমাদের জীবন যেন সংগীতের মূর্ছনায়, পুষ্পের সৌরভে আত্মবিকাশ লাভ করে। নববর্ষে এই কামনা।

WP2Social Auto Publish Powered By : XYZScripts.com